কৃষকের মাঠে যে পণ্যটির দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা, সেটিই যখন ক্রেতার হাতে পৌঁছায়, তখন তার দাম প্রায় একশ টাকার ওপরে চলে যায়।

প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশের কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বাজারে ক্রেতার হাতে

 পৌঁছাতে যে মূল্যবৃদ্ধির কৃষকদের যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করে,

 তেমনি ভোক্তারাও ন্যায্য দামে ফসল কিনতে পারেন না।


বাংলাদেশের কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বাজারে ক্রেতার হাতে পৌঁছাতে যে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি দেখা যাচ্ছে, তা দীর্ঘদিন ধরে দেশের কৃষি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি প্রধান সমস্যা। কৃষকের মাঠে যে পণ্যটির দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা, সেটিই যখন ক্রেতার হাতে পৌঁছায়, তখন তার দাম প্রায় একশ টাকার ওপরে চলে যায়। এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ মূল্যবৃদ্ধি বাজার ব্যবস্থার অদক্ষতা, মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব, সরবরাহ চেইনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া, এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার ফল। এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধি কৃষকদের যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করে, তেমনি ভোক্তারাও ন্যায্য দামে ফসল কিনতে পারেন না।

সমস্যার মূল কারণসমূহ



১. মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব

বাংলাদেশের কৃষি পণ্যের বাজার ব্যবস্থায় বেশ কিছু ধাপ থাকে যেখানে মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা অত্যন্ত শক্তিশালী। কৃষকরা সরাসরি ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারেন না, তাদের পণ্য প্রথমে পাইকারি ব্যবসায়ী বা দালালদের কাছে বিক্রি করতে হয়। এই মধ্যস্বত্বভোগীরা মূলত কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য কিনে তা অধিক দামে বাজারে বিক্রি করে। প্রতিটি পর্যায়ে তাদের দ্বারা পণ্যের দাম বাড়তে থাকে, এবং এর ফলে কৃষকের প্রাপ্ত দাম কমে যায়। অন্যদিকে, ভোক্তাকে এই পণ্যের জন্য উচ্চ মূল্য দিতে হয়। বাজার ব্যবস্থার এই ফাঁকফোকরগুলির কারণে কৃষকরা সঠিক মূল্য পান না এবং ভোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হন।

২. বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা

বাংলাদেশের অনেক বাজার ব্যবস্থাপনা এখনও সঠিকভাবে সংগঠিত নয়। কৃষিপণ্য সরবরাহের জন্য উন্নত অবকাঠামোর অভাব একটি বড় সমস্যা। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে পণ্য পরিবহনে অতিরিক্ত সময় এবং খরচ হয়। এর ফলে কৃষকদের পণ্য বাজারে পৌঁছাতে দেরি হয় এবং তা ফ্রেশ অবস্থায় বিক্রি করা সম্ভব হয় না। এতে করে ফসল নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়, এবং বাজারে পণ্য সংকট দেখা দেয়। এই সংকটই মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৩. সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ঘাটতি

বাংলাদেশে অনেক কৃষিপণ্য বিশেষ করে শাক-সবজি ও ফল সংরক্ষণে বড় ধরনের সমস্যা দেখা যায়। দেশে পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের সুবিধা না থাকার কারণে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করতে না পারার ফলে একদিকে ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়া যায় না, অন্যদিকে বাজারে সরবরাহ কমে যায়, যার ফলে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে।

৪. সরবরাহ চেইনের দীর্ঘতা

বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের সরবরাহ চেইন অত্যন্ত দীর্ঘ এবং জটিল। কৃষকের মাঠ থেকে ফসল ভোক্তার হাতে পৌঁছানোর জন্য একাধিক মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে তা বাজারে পৌঁছায়। প্রতিটি মধ্যস্থতাকারী তার নিজের লাভ যোগ করার ফলে পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। সরাসরি কৃষক থেকে ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রির কোনও কার্যকরী ব্যবস্থা না থাকায় এই সমস্যা দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে।

সমাধান ও করণীয়



১. কৃষক থেকে সরাসরি বাজারে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা

কৃষকদের সরাসরি বাজারে তাদের পণ্য বিক্রি করার সুযোগ প্রদান করা জরুরি। এর জন্য সরকার ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে বিশেষ কৃষক বাজার বা ‘ফারমার্স মার্কেট’ স্থাপন করা যেতে পারে। এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমবে এবং কৃষকরা তাদের ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবেন। একইসঙ্গে ভোক্তারা কম দামে পণ্য ক্রয় করতে পারবেন।

২. অবকাঠামোগত উন্নয়ন

কৃষিপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করতে হলে দেশের গ্রামীণ অবকাঠামো আরও শক্তিশালী করতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ সড়ক, পরিবহন ব্যবস্থা, এবং কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। উন্নত অবকাঠামোর মাধ্যমে ফসল দ্রুত ও নিরাপদে বাজারে পৌঁছানো সম্ভব হবে, যার ফলে মূল্যবৃদ্ধি কমবে।

৩. প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বিকাশ

কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বিকাশও মূল্য নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। পণ্য সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে কৃষিপণ্যকে দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ করা যায় এবং বাজারে সরবরাহ বজায় থাকে। এতে করে ফসলের নষ্ট হওয়ার পরিমাণ কমবে এবং বাজারে সংকট দেখা দেবে না, যার ফলে দামও স্থিতিশীল থাকবে।

৪. ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার

বর্তমানে প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সরাসরি কৃষক ও ভোক্তার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব। বিভিন্ন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকরা তাদের পণ্য সরাসরি ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করতে পারেন। এতে করে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমবে এবং পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকবে। এছাড়া, কৃষকরা বর্তমান বাজার দর সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাবেন এবং সঠিক সময়ে পণ্য বিক্রি করতে পারবেন।

৫. বাজার ব্যবস্থার সংস্কার

বাজার ব্যবস্থায় সমন্বয় আনা এবং এর জটিলতা কমাতে হলে সরকারের নীতি ও পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। বিশেষ করে, বাজারে স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ আনার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের আরও কার্যকর ভূমিকা থাকা উচিত। মধ্যস্বত্বভোগীদের দ্বারা কৃষকদের শোষণ বন্ধ করতে হলে নীতিমালা শক্তিশালী করা দরকার।

উপসংহার



কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের দাম ক্রেতার হাতে পৌঁছানোর সময় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া বাংলাদেশের কৃষি ও বাজার ব্যবস্থার একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হলে কৃষকরা তাদের প্রাপ্য ন্যায্য মূল্য পাবেন এবং ভোক্তারাও কম দামে পণ্য কিনতে পারবেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমানো, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, এবং সরবরাহ চেইনের জটিলতা দূর করার মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

সূত্র: গ্লোবাল নিউজ এবং সংবাদ সংস্থা

Post a Comment

Previous Post Next Post