ঢাকা উত্তরের বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে দুই মাস ধরে নিবন্ধনকাজ ব্যাহত

ঢাকা উত্তরের বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে দুই মাস ধরে নিবন্ধনকাজ ব্যাহত



আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ১০: ০২



১, অক্টোবর দুপুরে রাজধানীর উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, তা তালাবদ্ধ।

কিছু সময় পর সেখানে উপস্থিত হন কয়েকজন মশকনিধনকর্মী। তাঁদের দুজন মেহেদী হাসান ও হাবিবুর রহমান। তাঁরা জানান, কার্যালয়টি প্রায় দুই মাস ধরে তালাবদ্ধ। তাঁরা এসেছেন হাজিরা দিয়ে মশকনিধনের ওষুধ নিতে। কার্যালয়ে জন্ম–মৃত্যুনিবন্ধনসহ অন্যান্য কাজ বন্ধ রয়েছে। মশকনিধনকর্মীদের হাজিরা দেওয়ার সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন এসে তালা খুলে দেন।

রাজধানীর মিরপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ায় অবস্থিত কার্যালয়টির সামনে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর একজন এসে তালা খুলে দেন। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল ভাঙাচোরা কিছু জিনিস স্তূপ করে রাখা। একটি টেবিলে আধা পোড়া কাগজপত্রের ফাইল পড়ে আছে।

কবে থেকে কার্যালয়ে জন্ম–মৃত্যুনিবন্ধনসহ কাজ বন্ধ রয়েছে, জানতে চাইলে মো. রায়হান হোসেন নামের আরেক মশকনিধনকর্মী বলেন, গত ৬ আগস্ট থেকে কার্যালয়টি বন্ধ। সেদিন দুপুরের দিকে কিছু লোক এসে কার্যালয়ে ভাঙচুর চালায়। তারা কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার ও টেলিভিশন লুট করে নিয়ে যায়। কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে বিভিন্ন কাগজপত্র পুড়ে যায়।

রাজধানীর উত্তর সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। ১ অক্টোবর দুপুরেছবি: Global News

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। জানা গেছে, সরকার পতনের পর রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে হামলা হয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মোট ৫৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে পুরোনো (১ থেকে ৩৬ নম্বর) ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের দায়িত্ব পালন করে। বাকি ১৮টি ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মতো আঞ্চলিক নির্বাহী কার্যালয়ে গিয়ে এই নিবন্ধন করতে হয়। কিন্তু হামলার কারণে বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে নিবন্ধনসেবা বন্ধ হয়ে যায়। এসব কার্যালয়ে দুই মাস ধরে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ বন্ধ রয়েছে অথবা ব্যাহত হচ্ছে। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া ছিল। এ জন্য দেশজুড়ে গত ১৮ জুলাই থেকে ১০ দিন জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ বন্ধ ছিল।


এমন প্রেক্ষাপটে আজ ৬ অক্টোবর পালিত হচ্ছে জাতীয় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন, আনবে দেশে সুশাসন’।
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন গত সোমবার তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, কোনো ওয়ার্ডে দুই মাস ধরে নিবন্ধনের কাজ বন্ধ থাকলে তা তাঁদের দিকের সমস্যা। নিবন্ধনকাজ যেন ব্যাহত না হয়, সে জন্য ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের পরিবর্তে কারা দায়িত্ব পালন করবেন, কীভাবে নিবন্ধনের কাজ হবে, সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নিবন্ধনের কাজ করার জন্য ডিএনসিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত ৮০ জনকে পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। তাই জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ বন্ধ নেই।

যাহিদ হোসেন আরও বলেন, জন্মনিবন্ধন সনদ থাকলে একজন নাগরিক ২২টি সেবা নিতে পারেন। তাই সুশাসন নিশ্চিতে নির্ভুল জন্মনিবন্ধন দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের সিস্টেমের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৫৮ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬৪টি জন্মনিবন্ধন হয়েছে। আর মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছে ৫ লাখ ৫১ হাজার ৬৬০টি। অন্যদিকে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর—এই দুই মাসে ডিএনসিসিতে ১২ হাজার ৭৯৭টি জন্ম ও ৪৯০টি মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছে। ডিএসসিসিতে ৬ হাজার ৮০১টি জন্ম ও ২৬৭টি মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছে।




গত ২৬ সেপ্টেম্বর সিটি করপোরেশনের সব কাউন্সিলরকে অপসারণ করে সরকার। এর আগে বেশির ভাগ ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা পলাতক থাকায় নিবন্ধনের কাজে ব্যাঘাত ঘটে।

গত সপ্তাহে কোনো কোনো ওয়ার্ড সচিবকে অন্য ওয়ার্ডের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। যেমন ১১ নম্বর ওয়ার্ডে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের সচিব।

জানতে চাইলে ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের সচিব জোবায়ের আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, গত সপ্তাহে তিনি ১১ নম্বর ওয়ার্ডের অতিরিক্ত দায়িত্ব পেয়েছেন। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের আবেদনপ্রক্রিয়ার জন্য তাঁকে নতুন করে পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে হামলার ঘটনা ঘটেনি বলে জানান তিনি।


ডিএনসিসির ১১ নম্বর ওয়ার্ডের মতো একই অবস্থা রাজধানীর কালাচাঁদপুরে অবস্থিত ১৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের। সেখানে হামলা হওয়ায় নিবন্ধনকাজ বন্ধ রয়েছে। এই ওয়ার্ডের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সচিবকে। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের সচিবকে ১২ নম্বর ওয়ার্ডের, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সচিবকে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নিবন্ধনকাজের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।


এর আগেও নিবন্ধনসেবা পেতে ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে নাগরিকদের। গত বছর ‘সার্ভার ডাউন’ ও ই-পেমেন্টের কারণে নিবন্ধনের নতুন আবেদন ও সংশোধন নিয়ে নাগরিকদের ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয়। অবশ্য সিস্টেমের সক্ষমতা বাড়ানো ও ই-পেমেন্ট বন্ধ করা হলে চলতি বছর দেশজুড়ে ভোগান্তি কমে আসে।

তবে ডিএসসিসির কিছু সিদ্ধান্তের কারণে এই এলাকার বাসিন্দাদের ভোগান্তি জিইয়ে ছিল। ডিএসসিসি গত বছরের মাঝামাঝি সময় নিবন্ধন ফির অর্থ নিজস্ব তহবিলে জমার দাবিতে চার মাস নিবন্ধন বন্ধ রেখেছিল। এরপর ৪ অক্টোবর নিজস্ব সিস্টেম দিয়ে তারা নিবন্ধন শুরু করে। এই সিস্টেমের তথ্য কেন্দ্রীয় সার্ভারে জমা হতো না। ফলে এই নিবন্ধন নিয়ে বাসিন্দারা পাসপোর্টসহ অন্য সেবা নিতে পারতেন না।


আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত ১৪ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগ অফিস আদেশ জারি করলে ডিএসসিসির নিবন্ধনসংক্রান্ত তথ্য কেন্দ্রীয় সার্ভারে নেওয়া শুরু হয়। দীর্ঘদিনের জটিলতার অবসান ঘটে। তবে জন্ম ও মৃত্যুসনদ পেতে নাগরিকদের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি এখনো রয়ে গেছে।


‘এক সপ্তাহের মধ্যে নিবন্ধন কাজ স্বাভাবিক হবে’

ডিএনসিসির সার্বিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে গঠিত ২৫ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটির প্রথম সভা গত বৃহস্পতিবার নগর ভবনে অনুষ্ঠিত হয়।


সভার পর ডিএনসিসির প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, জন্ম–মৃত্যুনিবন্ধনসহ কাউন্সিলর কার্যালয়ে যেসব নাগরিক সেবা দেওয়া হতো, সেসব সেবার ঘাটতি মোকাবিলায় আলোচনা হয়েছে। যেসব কাউন্সিলর কার্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলোর তালিকা করা হচ্ছে।

প্রশাসক আরও বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে নিবন্ধনসহ অন্যান্য নাগরিক সেবার কাজ স্বাভাবিক হবে। কাউন্সিলরদের পরিবর্তে ওয়ার্ডগুলোয় সিটি করপোরেশনের সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও সমাজকল্যাণ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো ওয়ার্ড সচিবকে দুটি ওয়ার্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এখনো অনেক ওয়ার্ডের বাসিন্দারা জানেন না, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের সেবা তাঁরা কোথায় পাবেন। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কার্যালয়ের সামনে ব্যানার টাঙিয়ে প্রচার বাড়ানো হবে, যাতে বাসিন্দারা বুঝতে পারেন কোন ওয়ার্ডে গেলে সেবা পাবেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post

Smartwatchs